ইহুদিদের লাল গাভীর ইতিহাস

 1) লাল বাছুর/গাভী কি আসলেই কুরবানি করা হবে?

    -জ্বি, কথা সত্য। অন্তত, কুরবানির পরিকল্পনা আছে সংশ্লিষ্টদের।


    এ নিয়ে কি কোনো ভবিষ্যৎবাণী আছে ইসলামে?

    -না, একদমই নেই। শেষ সময়ের কোনো ভবিষ্যৎবাণীর সাথেই ইসলামে লাল বাছুরের সম্পর্ক নেই।


    তাহলে, এরকম কোনো গাভীর কথা কি আছে ইসলামে?

    -আছে, সূরা বাক্বারার নামকরণই করা হয়েছে এমন গরুর জন্য। সূরা আল বাক্বারা (الْبَقَرَة) অর্থ ‘গরু’। বিস্তারিত বলছি একটু পর।


    এ নিয়ে কি তাহলে ই/হু/দী ধর্মে কোনো ভবিষ্যৎবাণী আছে?

    -না, নেই। ই/হু/দী খ্রিস্টধর্ম বা ইসলাম কোনো ধর্মেই নেই। কিন্তু তিন ধর্মের ক্ষেত্রেই এরকম গাভীর কথা বলা আছে, অতীতের ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে।


    তাহলে, লাল বাছুর ইস্যু নিয়ে এত মাতামাতি কীসের?

    -এটার কোনো ধর্মীয় মাহাত্ম্য নেই, কিন্তু জিওপলিটিকাল মাহাত্ম্য আছে।


    এবার আসুন মূল আলাপ শুরু করা যাক। আমার লেখা একাধিক বইতে এ নিয়ে আলোচনা রয়েছে, কিন্তু যারা এখনও পড়েননি, তাদের জন্য সংক্ষেপে এ লেখা।


    বর্তমান মসীহবাদী ই/হু/দীদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন অপেক্ষা প্রতীক্ষা যা নিয়ে তার পেছনে আছে- এক পবিত্র লাল গাভী (হোলি কাও)। 


    যেমনটি বলা হলো একটু আগে, গাভীর কাহিনী আছে কুরআনেও, সূরা বাক্বারায়-


     “স্মরণ করো, যখন মূসা স্বীয় সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গরু জবাই করার আদেশ দিচ্ছেন।’ তারা বলেছিল, ‘তুমি (মূসা) কি আমাদের সঙ্গে মশকরা করছো?’ মূসা বলল, ‘আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যেন আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত না হই।’ তারা বলল, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো গরুটা কীরকম হবে।’ মূসা বলল, ‘আল্লাহ বলছেন, তা এমন এক গরু যা বৃদ্ধও নয় এবং অল্প বয়স্কও নয়- মধ্য বয়সী। সুতরাং যা (করতে) আদিষ্ট হয়েছ, তা পালন করো।’ তারা বলল, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো, গরুটার রং কী।’ মূসা বলল, ‘আল্লাহ বলছেন, তা পীত (হলুদ) বর্ণের গরু, তার রং উজ্জ্বল গাঢ়, যা দর্শকদেরকে আনন্দ দেয়।’ তারা বলল, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো গরুটি কেমন? কারণ সব গরুই আমাদের কাছে সমান, আর আল্লাহ চাইলে নিশ্চয়ই আমরা পথের দিশা পাব।’ মূসা বলল, ‘তিনি বলছেন, ওটা এমন এক গরু যা জমি চাষে ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়নি, বরং সুস্থ ও নিখুঁত।’ তারা বলল, ‘এখন তুমি সত্য প্রকাশ করলে।’ অবশেষে তারা সেটাকে জবাই করলো, যদিও তারা সেটা করতে প্রস্তুত ছিল না।” [সূরা বাক্বারা ২:৬৭-৭১]


    প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন এ গাভীর কথা বলা হয়েছিল? 


    তাফসির অনুযায়ী, এ ঘটনাটি বিশেষ একটি অলৌকিক কাজ বা মুজেজা দেখানোর বিষয়ে ছিল। মূসা (আ)-এর সময় বনী ইস/রাই/লের এক নিঃসন্তান বিত্তবান লোক ছিল, যার একমাত্র উত্তরাধিকার বলতে ছিল তার এক ভাইপো। সেই ভাইপো এক রাত্রে চাচাকে খু/ন করে লা/শ ফেলে দিলো। সকালবেলা হট্টগোল পড়ে গেল, কে এই ধনী লোককে হ/ত্যা করেছে? তখনও তারা জানতো না খুনী কে। খবর পৌঁছালো মূসা (আ) পর্যন্ত। ই/হু/দীরা তাকে ধরলো, কোনো না কোনোভাবে বলতে হবে কে খুনী। অর্থাৎ এখানে আল্লাহর সরাসরি হস্তক্ষেপ চাই তাদের। গোঁ ধরে বসে থাকা ই/হু/দীদের সন্তুষ্ট করতে মূসা (আ) আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন। তখন আল্লাহ বললেন, একটা গাভী জবাই করে সেটির কোনো অংশ মৃতদেহের গায়ে স্পর্শ করলে আল্লাহর কুদরতে মৃত লোকটি কিছুক্ষণের জন্য জীবিত হয়ে খুনীর নাম বলে আবার মৃত্যুর জগতে ফিরে যাবে। ই/হু/দীরা তখন মূসা (আ)-কে বলল, এটা তো যেকোনো গাভী হলে চলবে না নিশ্চয়ই, আপনি গিয়ে জিজ্ঞেস করেন ঠিক কীরকম গাভী চাই। এরকম অতিরিক্ত সব প্রশ্ন করায় তাদের জন্য রিকোয়ারমেন্ট কঠিন করে দেন আল্লাহ। শেষমেশ তারা গাভী জবাই করতে পেরেছিল অবশ্য। কুরআন অনুযায়ী, এই সেই গাভীর গল্প, যার নামে সূরার নামকরণ। 


    এ ঘটনাটি কুরআনে উল্লেখ করার কারণ অবশ্য শেষ জামানার কোনো সুপারন্যাচারাল ঘটনার আলামতের ইঙ্গিত দেয়া নয়। কুরআনে বলা হয়েছে, ই/হু/দীদের মতো এরকম নিয়ম-কানুন নিয়ে অযথা অতিরিক্ত প্রশ্ন না করতে, “তোমরা কি তোমাদের রাসূলকে সেরূপ প্রশ্ন করতে চাও যেরূপ প্রশ্ন পূর্বে মূসাকে করা হয়েছিল?” [সূরা বাক্বারা ২:১০৮] “হে মুমিনগণ, তোমরা সেসব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা তোমাদের কাছে প্রকাশ পেলে তোমরা কষ্ট পাবে… তোমাদের আগেও তো এক সম্প্রদায় এ ধরনের প্রশ্ন করেছিল…” [সূরা বাক্বারা ২:১০১-২]... 



2) মুসলিম শরিফের এক হাদিস অনুযায়ী, হজ্বের বিধান চালু হওয়ার পর একবার এক সাহাবী আকরা ইবনে হারিস (রা) নবী (সা)-কে প্রশ্ন করলেন, “আমাদের জন্য কি প্রতি বছরই হজ্ব ফরজ?” নবী (সা) এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। আকরা (রা) দুইবার তিনবার একই প্রশ্ন করলেন। তখন শাসনের সুরে নবী (সা) উত্তর দিলেন যে তিনি হ্যাঁ বললে সেটা পরে ফরজ হয়ে যেত, কিন্তু সেটা পালন করা যেত না। এজন্য এসব নিয়ে বেশি প্রশ্ন করা উচিৎ না, তাহলে আরও কঠিন নিয়ম আসতে পারে। নবী (সা) তখন বললেন, “যেসব বিষয় সম্পর্কে আমি তোমাদের কোনো নির্দেশ দিই না, সেগুলো নিয়ে তোমরা অবান্তর ও অর্থহীন প্রশ্নে লিপ্ত হয়ো না। তোমাদের আগে কোনো কোনো উম্মত বেশি বেশি প্রশ্ন করেই ধ্বংস হয়ে গেছে।”


এ তো গেল পবিত্র গাভী নিয়ে ইসলামি বিবরণ। কিন্তু ই/হু/দী বিবরণখানা কী?


হিব্রুতে এ গাভীকে বলা হয় ‘পারা আদুম্মা’ (פָּרָה אֲדֻמָּה) বা লাল গাভী (Red Heifer)। ‘পারা’ মানে গাভী। পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, আরবিতে কুরআনে বলা হয়েছে গাভীটি হবে পীত বা হলদে বর্ণের এবং উজ্জ্বল। ব্যাপারটি যে ই/হু/দীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে তা নয়। সাদিয়া গাওনের মতো বিখ্যাত ই/হু/দী ব্যাখ্যাবিশারদ হিব্রু ‘আদুমা’ (אֲדֻמָּה) শব্দটিকে ‘লাল’ নয় বরং হলদে অনুবাদ করেছেন। ই/হু/দী পণ্ডিতগণ অনেকেই ভেবেছেন, কেন এই গরু এত জরুরি, কিন্তু কোনো উত্তর না পেয়ে শেষমেশ এটিকে ঐশী আদেশ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন তারা, যার উত্তর স্রষ্টা ছাড়া কেউ জানেন না।


প্রশ্ন হচ্ছে, ই/হু/দী ধর্মে এই লাল গাভী কি অন্তিম সময়ের আলামত বাস্তবায়নের জন্য আদিষ্ট?


উত্তর হলো, মোটেও না। বর্তমান ই/হু/দীদের তোরাহ (যা কুরআনে উল্লেখিত তাওরাত কিতাব কনসেপ্ট থেকে ভিন্ন) অনুযায়ী, লাল গাভীকে উৎসর্গ করে তার পোড়ানো ছাই দিয়ে পবিত্রকরণ রিচুয়ালের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এটি সেসব ই/হু/দীদের জন্য যারা মানুষের লাশের সংস্পর্শে আসে, বা কোনো দেহাবশেষ বা কবর ছোঁয় (corpse uncleanness)।


লাল গাভীর নির্দেশনা ই/হু/দীদের তোরাহ-র গণনাপুস্তকে এসেছে এভাবে-


  “এর পর মাবুদ মূসা ও হারুনকে বললেন, ‘এ হলো আমার দেওয়া শরীয়তের একটি ধারা: তোমরা বনী ইস/রাই/লীদের এমন একটি লাল রংয়ের বক্‌না গরু তোমাদের কাছে আনতে বলবে যার গায়ে কোনো খুঁত নেই এবং যার কাঁধে কখনও জোয়াল চাপানো হয়নি। সেটা তোমরা ইমাম ইলীয়াসরকে দেবে। ছাউনির বাইরে নিয়ে তার সামনে এটা জবাই করতে হবে। তারপর ইমাম ইলীয়াসর তার আংগুলে করে কিছু রক্ত নিয়ে মিলন-তাম্বুর সামনের দিকে সাত বার ছিটিয়ে দেবে। তার সামনেই গরুটার চামড়া, গোশত, রক্ত ও নাড়িভুঁড়ি সুদ্ধ গোবর পুড়িয়ে দিতে হবে। গরুটা যখন পুড়তে থাকবে তখন ইমামকে কিছু এরস কাঠ, এসোব ও লাল রংয়ের সুতা তার উপর ছুঁড়ে দিতে হবে। এরপর ইমামকে তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে নিয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে। তারপর সে ছাউনির মধ্যে যেতে পারবে, তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে নাপাক অবস্থায় থাকতে হবে। যে সেই গরুটা পোড়াবে তাকেও তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে পানিতে গোসল করে ফেলতে হবে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নাপাক অবস্থায় থাকবে। পাক-সাফ অবস্থায় আছে এমন কোনো লোক সেই গরুটার ছাই তুলে নিয়ে ছাউনির বাইরে কোন পাক-সাফ জায়গায় রাখবে। সেই ছাই বনী ইস/রাই/লীরা পাক-সাফ করবার পানি তৈরির জন্য রেখে দেবে। এটা নাপাকী থেকে পাক-সাফ হওয়ার জন্য ব্যবহার করতে হবে। যে লোকটি সেই গরুর ছাই তুলে নেবে তাকেও তার কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলতে হবে এবং সে-ও সন্ধ্যা পর্যন্ত নাপাক অবস্থায় থাকবে। এটা হবে ইস/রাই/লীয় এবং তাদের মধ্যে বাস করা অন্য জাতির লোকদের জন্য একটা স্থায়ী নিয়ম।” [ওল্ড টেস্টামেন্ট, গণনাপুস্তক, ১৯:১-১০]


নিয়মটি নিয়ে আরও কথাবার্তা আছে, কিন্তু এটুকুই বোঝার জন্য যথেষ্ট। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখানেও গাভীটির বিষয়ে শর্তাবলি এতটাও কঠিন নয়, যেমনটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। ওই অতিরিক্ত জুড়ে দেয়া শর্তগুলো বিভিন্ন সময় ই/হু/দী র‍্যাবাই ও ব্যাখ্যাকারীগণ যোগ করেছেন, যা আমরা তোরাহ-র মৌখিক ব্যাখ্যাগ্রন্থ মিশনাহ (מִשְׁנָה)-তে দেখতে পাই। মিশনাহর আলাদা একটি অংশই রয়েছে এ গাভী নিয়ে, নাম হলো ‘মিশনাহ পারা’, সেখানে যুগে যুগে গাভীর নানা রিকোয়ারমেন্ট যোগ করেছেন ই/হু/দী ধর্মগুরুগণ। যেমন, গাভীটির প্রাকৃতিক জন্ম হতে হবে, সিজার করা যাবে না। যদি বাছুরটির শরীরে দুটোও কালো পশম পাওয়া যায়, তাহলেও বাতিল। গাভীটিকে কুমারী হতে হবে। তিন বছরের কম বা আশপাশে হতে হবে। কোনো পশম কোকড়ানো হতে পারবে না, সব স্ট্রেইট হবে। রিচুয়ালে যে পানি ব্যবহার করা হবে, সেটি অবশ্যই ঝর্ণার পানি হতে হবে, বৃষ্টির পানি বা অন্য পানি হলে হবে না।



3) ই/হু/দী ধর্মের আদি গ্রন্থ অনুযায়ীও যে থার্ড টেম্পলের সাথে লাল বাছুরের কোনো সম্পর্ক নেই, তার প্রমাণ হলো, মূসা (আ)-এর সময় যখন এ আদেশ নাজিল হয়, তখনও টেম্পল অফ সলোমন বা বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মিতই হয়নি। ই/হু/দী হিসেব মতে, মূসা (আ) খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ সালের দিকে জীবিত ছিলেন। তারও প্রায় চারশো বছর পর খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে নয়শ সালের দিকে সুলাইমান (আ) বা সলোমনের সময়কাল, তখন যে বাইতুল মুকাদ্দাস গড়ে ওঠে সেটিই 'ফার্স্ট টেম্পল অফ সলোমন' নামে পরিচিত। এটি প্রায় ৩৭০ থেকে ৪১০ বছর টিকে ছিল, এরপর ব্যবিলনের রাজা দ্বিতীয় নেবুকাদনেজার খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭ সালে সেটি ধ্বংস করে দেন, নির্বাসিত করেন ই/হু/দীদেরকে। নির্বাসন শেষে খ্রিস্টপূর্ব ৫১৫ সালের দিকে ই/হু/দীরা পুনরায় বাইতুল মুকাদ্দাস স্থাপনা নির্মাণ করে, যা 'সেকেন্ড টেম্পল অফ সলোমন' নামে পরিচিত। সেটি টিকে থাকে খ্রিস্টীয় ৭০ সাল পর্যন্ত, যখন রোমান সম্রাট টাইটাস টেম্পল ধ্বংস করে দেন (তখনও টাইটাস সম্রাট হননি, জেনারেল ছিলেন)। এ টাইমলাইনটুকু খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমরা যেসব ই/হু/দী ব্যাখ্যাগ্রন্থ দেখতে পাই, সেগুলোর বেশিরভাগ লেখনিই এই সেকেন্ড টেম্পল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে লেখা। এটিকে 'সেকেন্ড টেম্পল পিরিয়ড' বলে। এমনকি মেসায়ার আগমনের জন্য যত প্রত্যাশা সেগুলোও এসময়ে লেখা। সেকেন্ড টেম্পল পিরিয়ডে আমরা লাল গাভী নিয়ে যতগুলো আদেশ নির্দেশ নিয়মাবলি দেখতে পাই, সেগুলো কম করে হলেও মূসা (আ)-এর হাজার কি তেরশো বছর পরে লেখা, এবং কোনো ঐশীবাণীর মধ্য দিয়ে আসা নয়। আমরা দেখতে পাই, সেই সময় বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকার পাশে মাউন্ট অলিভস বা জলপাই পাহাড়ে এই কুরবানির আয়োজন করা হতো। সেখান থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার জন্য বড় র‍্যাম্প নির্মাণ করা হতো, যেন মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া না লাগে, কারণ মাটিতে কারও না কারও কবর থাকতে পারে, মাটির নিচে লাশ থাকতে পারে, এত কষ্ট করে রিচুয়াল পালনের পর এসব অশুচির পরশে অপবিত্র হয়ে গেলে চলবে? আপনি যদি লাল গাভীর লেখনিগুলো পড়েন তাহলে দেখতে পাবেন, সেখানে লেখাগুলো এমনভাবেই লেখা যে লেখক জানেন টেম্পল তো দাঁড়িয়েই আছে, এখান থেকে একটু দূরে রিচুয়াল সেরে ছাই নিয়ে টেম্পলে কাজ সারতে হবে। তারা তখনও কেউ জানতেন না যে টেম্পল ধ্বংস হয়ে যাবে।


অর্থাৎ, প্রথমত, মূসা (আ)-এর সময় টেম্পল বা বাইতুল মুকাদ্দাস স্থাপনা গড়েই ওঠেনি, তাই এর সাথে গাভীর কোনো সম্পর্কই তখন থাকতে পারে না। কুরআনেও নেই।


দ্বিতীয়ত, ই/হু/দী ধর্মগুরুরা যখন মিশনাহ রচনা শুরু করেন, তখন সেকেন্ড টেম্পল অফ সলোমন সগৌরবে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে, তখন টেম্পল পুনর্নিমাণের কোনো ভবিষ্যৎবাণী তাদের কাছে প্রশ্নাতীত। ইন ফ্যাক্ট, তারা যীশু খ্রিস্ট বা ঈসা (আ)-কে রোমান কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন এই বলে যে, যীশু সেকেন্ড টেম্পল অফ সলোমন ধ্বংস করার কথা বলেছেন, কতো বড় স্পর্ধা! অথচ এর চল্লিশ বছরের মাথায় সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। সুতরাং, এই পিরিয়ডের লাল গাভী নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎবাণী থার্ড টেম্পল নির্মাণ নিয়ে নয়, এটুকু নিশ্চিত। এ যেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়তে থাকা কোনো সৈনিককে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলামতের কথা বলা, যেখানে সে জানেই না তার যুদ্ধটি ‘প্রথম’।


তৃতীয়ত, ৭০ সালে বাইতুল মুকাদ্দাস স্থাপনা রোমানদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ই/হু/দীরা দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়ে। তারা আরও বেশি করে মেসায়ার আগমনের প্রত্যাশী হয়ে পড়লো, যিনি এসে তাদেরকে উদ্ধার করবেন। আবার সব ই/হু/দী সুখে শান্তিতে বসবাস করবে পবিত্র ভূমিতে, মেসায়া পুনর্নির্মিত থার্ড টেম্পল থেকে দুনিয়া শাসন করবেন। এই দুই হাজার বছরে থার্ড টেম্পল নিয়ে নানা রকমের ভবিষ্যৎবাণী ই/হু/দী ধর্মে যুক্ত হয়েছে, যেগুলো কোনোটিই নবীদের ঐশী বাণী নয়, বরং ই/হু/দী র‍্যাবাইদের আধ্যাত্মিক বর্ণনা। ই/হু/দীরা র‍্যাবাইদের বাণী অনেক গুরুত্বসহকারে মানে, তাই এই ভবিষ্যৎবাণীগুলো মেসায়াপ্রত্যাশীদের বিশ্বাসের অংশ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এগুলো ই/হু/দী শরীয়তের অংশ নয় বিধায় মূলধারার ই/হু/দী পণ্ডিতগণ প্রত্যাখ্যান করেন, এগুলোকে ‘বিদআত’ বা পরবর্তী সংযোজন মনে করেন।



4) /হু/দীদের গাভীর যে মিশনাহ কিতাবের কথা বললাম, সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, মূসা (আ)-এর সময় থেকে এখন পর্যন্ত ৯টি লাল গাভী কুরবানি করা হয়েছে। মূসা (আ) প্রথম গাভীটি কুরবানি করেন, এরপর করেন উজাইর (আ), এরপর সেকেন্ড টেম্পল সময়কালের প্রধান ইমাম শিমিয়ন দুটো গাভী কুরবানি করেন, তারপর পঞ্চম প্রধান ইমাম ইয়োহানান দুটো গাভী কুরবানি করেন (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ সালের আগে), এরপর ইমাম এলিইয়াহুয়েনাই, প্রধান ইমাম হানামীল (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক) এবং প্রধান ইমাম ইশমায়েল বেন ফাবুস (খ্রিস্টীয় ১৫-১৬ সাল) একটি করে লাল গাভী কুরবানি করেন। এরপর আজ পর্যন্ত গত ২০০৮ বছর ধরে ই/হু/দীদের কোনো লাল গাভী কুরবানি করা হয়নি। [পুড়িয়ে কুরবানি করা একটি পুরনো ইহুদী রীতি, যখন কোনো কুরবানির উদ্দেশ্য কেবলই ঈশ্বরের জন্য হয়ে থাকে এবং তা থেকে গোশত ভক্ষণের উদ্দেশ্য না থাকে, তখন এটি করা হয়, একে হিব্রুতে ‘কুরবান-ওলা’ (קָרְבַּן עוֹלָה) বলে, বাংলা বাইবেলে একে হোমবলি' অনুবাদ করা হয়েছে।]


ই/হু/দী ধর্মগুরুরা আরও একটি কঠিন শর্তও জুড়ে দিয়েছিলেন এ রিচুয়ালকে আরও পবিত্র করতে, আর সেটি হলো- কোনো লাল গাভী কুরবানি দেয়ার সময় আগের লাল গাভীর ভস্ম ব্যবহার করতে হবে। তাই তৎকালীন সময়ে তারা কুরবানি করা লাল গাভীর ভস্ম কিছুটা জমিয়ে রাখতেন পরবর্তীতে কবে ব্যবহার হবে সেজন্য। ৭০ সালে রোমানদের গুঁড়িয়ে দেয়া বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকাতেই কোথাও সেই আদিভস্ম থাকার কথা। বলা হচ্ছে (অপ্রমাণিত), এবার যারা লাল বাছুর কুরবানির রিচুয়ালের দায়িত্বে আছে, তারা নাকি তাদের প্রত্নতাত্ত্বিকদের সহায়তায় সেই পুরাতন লুকায়িত ভস্ম উদ্ধার করেছে নতুন কুরবানিতে ব্যবহারের জন্য।


ইসলাম আর ই/হু/দী বিশ্বাস গেল, খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে কী রয়েছে লাল গাভী নিয়ে? ই/হু/দীদের মূল তোরাহ কিতাবে যা উল্লেখ আছে, সেটিই খ্রিস্টানদের বিশ্বাস। এর বাইরে ইভানজেলিকাল খ্রিস্টানদের এ নিয়ে অতি আগ্রহ রয়েছে। কারণ, তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ই/হু/দীরাই যীশুকে ক্রুশে দেয়ার জন্য রোমানদের রাজি করায়, সেই হিসেবে ই/হু/দীরা তাদের শত্রুপক্ষ হওয়ার কথা। কিন্তু ইভানজেলিকাল খ্রিস্টানরা ই/হু/দীদের সাথে শত্রুতা না করে তৃতীয় টেম্পল নির্মাণে সহায়তা করতে রাজি, তাদের বিশ্বাস টেম্পল নির্মাণ করলেই যীশু খ্রিস্ট আবার ফিরে আসবেন এবং হত্যা করবেন অ্যান্টিক্রাইস্টকে (যাকে মুসলিমরা মাসিহ ‘আদ-দা/জ্জাল’ বলে থাকে), যে অ্যান্টিক্রাইস্ট আবার ই/হু/দীদের প্রতীক্ষিত মেসায়া। ইভানজেলিকাল খ্রিস্টানদের কাছে লাল গাভীর এ লাল রঙ নাকি আসলে রূপকার্থে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর রক্ত। এরকম থার্ড টেম্পল প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানা অতিরঞ্জন রয়েছে মেসায়াবাদী ই/হু/দী বিশ্বাস ও ইভানজেলিকাল খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে। এবং এগুলোর পুরোটাই অনেক পরে যোগ করা, তাই এগুলোর ঐশী গুরুত্ব নেই। এটিই বোঝানো এ পোস্টের দুটো উদ্দেশ্যের একটি।


অপর যে উদ্দেশ্য নিয়ে এ রচনা লেখা, সেটি হলো, এই লাল গাভী নিয়ে মাতামাতির মাহাত্ম্য কী তাহলে? মৌলিক ধর্মীয় গুরুত্ব যে নেই তা তো বোঝাই গেল, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। বর্তমানে ফিলিস৩-এর গা/জায় যে আগ্রাসন চলছে (যা অক্টোবরের ৭ তারিখ শুরু হয়েছিল), হঠাৎ করেই তাতে লাল গাভীর কথা উঠে এসেছে। ১০০তম দিনে হা/মা/সের মুখপাত্রের বক্তব্যে জানা যায়, তাদের যুদ্ধ করার অন্যতম একটি মোটিভ হলো- ইস/রাইল যেন লাল গাভী নিয়ে না আসে জেরু/জালেমে। এরকম একটি সিরিয়াস রক্তাক্ত যুদ্ধের আলোচনায় লাল গাভীর মতো বিষয় উঠে আসা অবাক করা, তাই না?


ইসলামি কোনো বিশ্বাসেই ভবিষ্যতে লাল গাভীর কোনো স্থান নেই। মূল ই/হু/দী বিশ্বাসেও নেই, সেটাও আমরা এখন জানি। তারপরও কেন এটা নিয়ে আলোচনার দরকার আছে? দরকার- কারণ, ‘টেম্পল ইনস্টিটিউট’ বা ‘রিবিল্ড জেরু/জালেম’-এর মতো যে সংঘগুলো থার্ড টেম্পল নির্মাণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তাদের দাবী, কেবল এই লাল গাভী কুরবানি দেয়া হয়ে গেলেই আল -আকসা কমাউন্ডের বর্তমান স্থাপনা গুড়িয়ে সেখানে থার্ড টেম্পল অফ সলোমন বানানো শুরু করা যাবে। সিবিএসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে উভনে জেরু/জালেম বা রিবিল্ড জেরু/জালেমের ইসহাক মামো বলেন, “অনেক খোঁজার পর আমরা গরগুলোকে টেক্সাসে পেয়েছি। টেক্সাস রেড অ্যাংগাস। হ্যারি পটার গল্প হতে পারে, বাইবেল গল্প নয়, বাইবেল আমাদেরকে ঈশ্বরের পথ দেখায়।” ইসহাক মামোই বাছুরগুলোকে জেরু/জালেমে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। পশ্চিম তীরে থাকা এ বাছুরগুলোকে জেরু/জালেমের জলপাই পাহাড়ে সাদা বেদীতে কুরবানি করা হবে। সেগুলোর ভস্ম দিয়ে পবিত্র করা হবে সেসব যন্ত্রপাতি যেগুলো দিয়ে নির্মাণ করা হবে থার্ড টেম্পল অফ সলোমন।


কোনো ই/হু/দী ফার্মে বেড়ে ওঠেনি বাছুরগুলো, উঠেছে খ্রিস্টান ফার্মে। যে টেক্সাসবাসী বাছুরগুলোকে ইস/রাই/লে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছেন তার নাম বায়রন স্টিনসন; ৩১ জানুয়ারি তিনি বলেন, “মেসায়ার আসা জরুরি, আমরা মেসায়াকে বরণ করে নিব। আমার বিশ্বাস, এই লাল বাছুরের লাল হওয়ার কারণ যীশু খ্রিস্টের রক্ত।”



5) পশ্চিম তীরে যে গোয়ালে এই বাছুরগুলোকে রাখা হয়েছে সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কেউ যদি গায়ের জামাটিও কোনো বাছুরের কাঁধে রাখে, তাহলেও সেটি বাতিল হয়ে যাবে। বলা হচ্ছে (অপ্রমাণিত), টেক্সাস থেকে ২০২২ সালে আনা ৫টি বাছুরের মাঝে একটির খুঁত ধরা পড়েছে, আরেকটির নাকি বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, ইত্যাদি নানা গুজব শোনা যাচ্ছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বাছুরগুলোর জন্ম, এটিও শোনা যায়- নাহলে এখন এমন নিখুঁত লাল বাছুর পাওয়া যায় না। বাছুরগুলোর কুরবানি করার তারিখ হিসেবে ২৯ মার্চ, ২২ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল- এরকম নানা তারিখের কথা শোনা যায়। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহটি হলো পাসওভার, বা ই/হু/দীদের ঈদুল ফিসাহ- এটি তারা মিশর থেকে মূসা (আ)-এর নেতৃত্বে হওয়া হিজরত বা এক্সোডাসের স্মরণে পালন করে থাকে। এই পাসওভারের সময় কুরবানি করাটা একটি মোক্ষম সময়, আবার এর দুই তিন সপ্তাহ আগে কোনো সাব্বাৎ দিবসের (শনিবারের) আগের সন্ধ্যায় করাটাও সুসময় তাদের জন্য। 


ই/হু/দীদের তোরাহ কিতাব বা অন্যান্য নবীদের কিতাব বলে যে, বিশেষ এক নবী আসবেন। আর সেই সাথে ‘অন্তত’ একজন মসীহ (Messiah) আসবেন। সেই নবী কে হবেন, সেটি আপাতত আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়- সেটি অনেক বড় আকারের লেখনি, নবী নিয়ে ই/হু/দীদের এখন অত মাথাব্যথা নেই। কিন্তু সেই ‘মেসায়া’ (ক্রাইস্ট) কে হবেন, সেটা বড়ই গুরুত্বপূর্ণ।


মেসায়ার আগমন যে যুদ্ধকে ঘিরে হবে সেটি ই/হু/দী খ্রিস্টধর্ম বা ইসলাম- তিনধর্মেই আছে। ইংরেজিতে একে বলে ‘আর্মাগেডন’ (Armageddon)। এটি আসলে কোনো মূল ইংরেজি শব্দ নয়, বরং এটাও হিব্রু থেকে এসেছে। মূল শব্দটি ছিল ‘হার মেগিদো’ (הַר מְגִדּוֹ) অর্থাৎ ‘মেগিদো পাহাড়’। ই/হু/দীদের বিশ্বাস করা ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী, মেগিদো টিলার কাছেই সর্বশেষ মহাযুদ্ধের বাহিনীগুলো জড়ো হবে। এজন্যই এর নাম ‘আর্মাগেডন’। এতে ই/হু/দীদের নেতৃত্ব দেবেন তাদের মেসায়া। যার আগমন হবে তৃতীয় টেম্পল নির্মাণ করলে।


তাদের এই বিশ্বাসের দাম ইসলামি সূত্রে নেই। কিন্তু বিশ্বাস অবিশ্বাস যা-ই থাকুক না কেন, লাল বাছুরের উৎসর্গের মধ্য দিয়ে যদি আগ্রাসনের নতুন মোড় হয় আকসা বিধ্বংস, তাহলে পবিত্র ভূমিতে রক্তপাত কোথা থেকে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। আর একারণেই লালীর মতো লৌকিক বিশ্বাস ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বেড়াজাল পেরিয়ে আজ ভূরাজনৈতিক চিন্তার বিষয়।


এখন দেখবার পালা, বাছুরগুলোর পরিণতি বিশ্বরাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেবে কি দেবে না।


সোর্স: আবদুল্লাহ বিন মাহমুদ।






Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url